শিক্ষায় এ
ক’বছরে আমাদের অর্জন অনেক । শিক্ষায় অবকাঠামোর উন্নয়ন , ঝরে পড়ার হার
হ্রাস , মেয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা বৃদ্ধি , উপবৃত্তি ও বিনামূল্যে
পাঠ্যপুস্তক প্রদান, সৃজনশীল পরীক্ষা পদ্ধতি চালু , শিক্ষাস্তর কাঠামোর
পুনর্বিন্যাস , পর্যাপ্ত শিক্ষক নিয়োগ , সেশনজট কমানো ইত্যাদি ক্ষেত্রে
আমরা আমাদের অনেক প্রতিবেশীর চেয়ে এখন এগিয়ে । সর্ব সাম্প্রতিক আমাদের
শিক্ষায় আইসিটির ব্যবহার ও প্রয়োগ শিক্ষাক্ষেত্রে যুগোপযোগি একটি ধারা
সংযোজন করেছে । শিক্ষার নানা সুচকে আমাদের অবস্থান আগের চেয়ে অনেক ভাল ।
এখন তথ্য প্রযুক্তির অবাধ প্রবাহের যুগ ।
জীবনের প্রতিটি অধ্যায়ে প্রযুক্তির হাতছানি । এর ছোঁয়ায় মানব সভ্যতার
উৎকর্ষতা অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে । আর দশ-কুড়িটা বছর পর প্রযুক্তির সহায়তায়
পৃথিবী নামের গ্রহটি কোথায় গিয়ে পৌঁছাবে , তা’ এখন কল্পনা করা ও কঠিন কাজ ।
দেশে শিক্ষা ক্ষেত্রে আইসিটির ব্যাপক ব্যবহার ও প্রয়োগ আমাদের শিক্ষার মান
মর্যাদা কিছুটা হলেও বাড়িয়ে দিয়েছে । এর বহুমুখি ব্যবহার ও প্রয়োগ
নিঃসন্দে এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ । প্রযুক্তি ব্যবহার করে শ্রেণিকক্ষে
পাঠদান শিখন-শেখানো কার্যক্রমকে বহুলাংশে আকর্ষণীয়, কার্যকর ও গতিশীল করে ।
মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর ব্যবহার করে শ্রেণিতে পাঠদান শিক্ষকদের যেমন
স্মার্ট ও আধুনিক প্রযুক্তি মনস্ক করে , তেমনি শিক্ষার্থীদের শ্রেণি পাঠে
অধিকতর মনযোগি ও প্রযুক্তি নির্ভর শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে ওঠবার বিষয়ে উৎসাহিত
করে তুলে । শিক্ষক যখন পাওয়ার পয়েন্টে গিয়ে নানা স্লাইড তৈরী করে কন্টেন্ট
প্রস্তুত করেন, তখন তিনি পাঠের একেবারে গভীরে পৌঁছে যান । আবার যখন
শ্রেণিকক্ষে কন্টেন্টটি প্রজেক্টরের সাহায্যে শিক্ষার্থীদের সামনে
প্রেজেন্টেশন দেন , তখন তিনি নিজের দক্ষতা ও অভিজ্ঞতায় ভিন্ন এক তৃপ্তি
উপভোগ করেন । এতে শিক্ষার্থীদের মধ্যে আরো নিবিড় শিখনের অনুপ্রেরণা জাগ্রত
হয় । তাই মাল্টিমিডিয়া ক্লাস বর্তমান সময়ের জন্য পাঠদানের সর্বোত্তম উপায়-
তাতে সন্দেহ নেই ।
আমাদের শ্রেণি গুলোতে আজকাল অনেক
শিক্ষার্থী । একজন শিক্ষক গতানুগতিক ধারার শ্রেণি পাঠদানে নানা ভাবে হিমশিম
খেয়ে থাকেন । এক- দেড়শ’ শিক্ষার্থীকে শান্ত রেখে পাঠদান করা অনেক সময়
সম্ভব হয় না । পেছনের শিক্ষার্থীগণ শ্রেণিতে প্রায়শঃ অমনযোগি থাকে ।
শ্রেণিতে গোলমাল ও হৈচৈ করে । কোন কোন শিক্ষক শ্রেণি পাঠদানে একান্ত অসহায়
হয়ে পড়েন । তদুপরি, বিভিন্ন শ্রেণিতে অনেকগুলো ক্লাস নেবার পর একজন
শিক্ষকের ক্লান্ত হয়ে পড়ারই কথা । চক-ডাস্টার ও ব্ল্যাকবোর্ড ব্যবহার করতে
করতে পরিণত বয়সের আগেই অনেকে চোখ ও ফুসফুসের নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হয়ে
পড়েন । গবেষণার ফলাফল থেকে এ সব তথ্য বেরিয়ে এসেছে ।
বর্তমান সরকার শ্রেণি পাঠদানের ক্ষেত্রে
মাল্টিমিডিয়া ক্লাসের ওপর গুরুত্বারোপ করেছে । প্রাথমিক স্তর থেকে শুরু
করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত মাল্টিমিডিয়া ক্লাস কার্যক্রমের ওপর এ গুরুত্ব
প্রদান করা হয়েছে । মাল্টিমিডিয়া ক্লাসের উপযোগি করে নতুন নতুন শ্রেণিকক্ষ
নির্মাণ করা হচ্ছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সমুহে কম্পিউটার, ল্যাপটপ, প্রজেক্টর
ও স্ক্রিন সরবরাহ করা হচ্ছে । এর সুবাদে বিদ্যুতের প্রসার বেড়েছে।
শিক্ষকদের আইসিটি বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে । আইসিটি শিক্ষা বাধ্যতামুলক
করা হয়েছে।অনেক শিক্ষা প্রতিষ্টানে শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাব প্রতিষ্ঠিত
হয়েছে। শুনা যাচ্ছে, পর্যায়ক্রমে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এ ল্যাব স্থাপন
করা হবে । এ সবই আইসিটি বিষয়ে সরকারের আন্তরিক ও ইতিবাচক মনোভাব প্রকাশ করে
।
মাল্টিমিডিয়া ক্লাসের অনেক সুবিধা ।
শিক্ষকের গতানুগতিক চক-ডাস্টারের ব্যবহার কমে আসার ফলে নানা রোগে আক্রান্ত
হবার আশংকা কমে যায় । শিক্ষার্থীদের দৃষ্টি ও মনযোগ স্ক্রিনে থাকে বলে তারা
হৈচৈ ও গোলমাল থেকে বিরত থাকে । শ্রেণি পাঠ আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে । পরোক্ষভাবে
হলে ও ঝরে পড়া রোধ এবং শ্রেণি উপস্থিতি বৃদ্ধি পায় । শিক্ষার্থীদের
মুখস্ত করার প্রবণতা কমে যায় ।
যে কোন প্রতিষ্ঠানে আইসিটি শিক্ষা ও
মাল্টিমিডিয়া ক্লাস কার্যক্রম বাস্তবায়ন ও পরিচালনার ক্ষেত্রে আইসিটি
শিক্ষক মূল চালিকা শক্তির কাজ করেন । একটা প্রতিষ্ঠানে সব শিক্ষকের
মাল্টিমিডিয়া ক্লাস পরিচালনা করার কথা । তাদের কন্টেন্ট তৈরীতে সহযোগিতা ,
মাল্টিমিডিয়া উপযোগি শ্রেণি কক্ষ না থাকলে প্রত্যেক শ্রেণিতে প্রতিদিন
প্রজেক্টর ও স্ক্রিন প্রতিস্থাপন, আইসিটি’র ইনহাউজ ট্রেনিংয়ে প্রধান
প্রশিক্ষকের ভুমিকা পালন, ল্যাব থাকলে এর তদারকি ও জিনিসপত্র সংরক্ষণ
ইত্যাদি নানা কাজ আইসিটি শিক্ষক একাই করে থাকেন । এ ছাড়া প্রতিষ্ঠানের
অনলাইন বিষয়ক সকল কাজ ; যেমন : ই-এসআইএফ , ই-এফএফ ,ই-এডমিশন , ই-স্টাইপেন্ড
, ই-রেজাল্ট ইত্যাদি কাজ মুলতঃ আইসিটি শিক্ষক সম্পাদন করে থাকেন । শুধু কী
তাই ? PBM, IMS, EMIS -এর নানা কাজে ডাটা এন্ট্রি দেবার সময় ডাক পড়ে
আইসিটি শিক্ষকের । অনেক প্রতিষ্ঠান আছে, যাদের আইসিটি শিক্ষক না থাকায় এসব
কাজে বহু বেগ পেতে হয় । কেউ কেউ টাকা পয়সা খরচ করে এ সব কাজ বাইরে কোথাও
গিয়ে সম্পাদন করেন । এতে অনেক ভুল-ভ্রান্তির আশংকা থেকে যায় ।
আইসিটি এখন আবশ্যিক বিষয়। একটি
প্রতিষ্ঠানে মাত্র একজন আইসিটি শিক্ষক দিয়ে কীভাবে চলে ? যেখানে বাংলা,
বিজ্ঞান কিংবা সমাজ বিজ্ঞানের মতো কম গুরুত্বপুর্ণ বিষয়ে একাধিক শিক্ষক
থাকেন, সেখানে আইসিটির মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে একজন কেন ? শুনেছি , সরকারি
স্কুলসমুহে আইসিটি শিক্ষকের কোন পদই নেই । এ কেমন কথা ?
বেসরকারি স্কুল-কলেজে আর ক’জনই বা আছেন ?
অনেক প্রতিষ্ঠানে এ পদটি খালি পড়ে আছে । এদিকে ১৩.১১.১১ তারিখের পর যে সকল
শিক্ষক আইসিটি পদে বিধি মোতাবেক নিয়োগ প্রাপ্ত হয়ে ও ছয়-সাত বছর ধরে বিনে
বেতনে কাজ করে আজোবধি বেতন পান নাই, তাদের কী দোষ ? তাদের নিয়ে আজ ক’টা
বছর ধরে এমপিও দেই-দিচ্ছে করে ও দেয়া হচ্ছেনা । ফাইল এখান থেকে ওখানে যায় ।
ডিজি অফিস থেকে মন্ত্রণালয়ে আবার মন্ত্রণালয় থেকে ডিজি অফিসে । উপজেলা
মাধ্যমিক শিক্ষা অফিস ও জেলা শিক্ষা অফিস কতবার যে আইসিটি শিক্ষকদের তথ্য
নিয়েছে, তার হিসেব কে রেখেছে ? কিন্তু, এরপরও তাদের বেতন নেই। এর দায় কার ?
কার কারণে আইসিটি সহ সৃষ্ট পদের অন্যান্য বিষয়ের শিক্ষকগণ এতটি বছর ধরে
প্রিয় পরিবার পরিজন নিয়ে উপোস ?
আইসিটি শিক্ষকদের উপোস রেখে কীভাবে আইসিটি শিক্ষায় এগিয়ে যাওয়া যায় ? কতটুকু মাল্টিমিডিয়া ক্লাস চালু ও বাস্তবায়ন করা সম্ভব ?
আইসিটি শিক্ষার অফুরন্ত ও অপার সম্ভাবনা
আমাদের দেশে । এ শিক্ষার প্রতি আমাদের নতুন প্রজন্মের ঝোঁক অনেক বেশী ।
গতানুগতিক সাধারণ শিক্ষার চেয়ে এ শিক্ষায় তারা হাতে কলমে বেশী স্বাচ্ছন্দ্য
বোধ করে । বিশ্বায়নের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার উপযোগি করে আমাদের ভবিষ্যত
প্রজন্মকে গড়ে তুলতে আইসিটি শিক্ষা এখন তাই অপরিহার্য । তারচে’ বেশি
অপরিহার্য আইসিটি শিক্ষকদের মুল্যায়ন । তাদের অবিলম্বে এমপিও প্রদান করে
মাল্টিমিডিয়া ক্লাস শতভাগ বাস্তবায়নে তাদের অমিত প্রতিভা ও সম্ভাবনাকে কাজে
লাগানো প্রয়োজন । তা না হলে স্রেফ মাল্টিমিডিয়া ক্লাস আমাদের খুব একটা
সুফল দেবে বলে মনে হয় না ।
আইসিটি ও কারিগরি শিক্ষার ওপর জোর না দিলে
আমাদের ২০৪১’র টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রাটি কীভাবে অর্জিত হবে? আইসিটি
শিক্ষকদের উপোস রেখে আইসিটি শিক্ষার ওপর যতই জোর দেওয়া হউক না কেন, তা হবে
গোড়া কেটে ডালে পানি ঢালার সমান একটি কাজ । তাতে ফল শুন্য হবারই কথা ।
ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার অঙ্গিকার
স্বয়ং আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রির । তার সুযোগ্য পুত্র ও আইসিটি উপদেষ্টা
সজীব ওয়াজেদ জয় বিশ্ব আইসিটি অঙ্গনে এক উজ্জল তারকা । এ দু’জনের হাত ধরেই
আমাদের আইসিটি জগতে অনুপ্রবেশ । এ সময়ে বাংলাদেশে আইসিটি শিক্ষকরা তাদের
পরিবার পরিজন নিয়ে দু’বেলা দু’মুটো ভাত খেতে না পেলে সে লজ্জা কার হবে ?
তাই, সামনের এমপিওতে আইসিটিসহ সকল আবশ্যিক বিষয়ের শিক্ষকদের বেতন প্রদান
করে জাতিকে দায়মুক্ত করা একান্ত অপরিহার্য ।
লেখক : অধ্যক্ষ, চরিপাড়া উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ, কানাইঘাট, সিলেট ও দৈনিকশিক্ষার নিজস্ব সংবাদ বিশ্লেষক
সূত্রঃ
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন